সম্প্রতি, চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হুশিয়ারি প্রদান করেছেন দাবিতে চ্যানেল ২ এর প্রতিবেদনের আলোকে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইলিয়াস কাঞ্চন সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে হুঁশিয়ারি প্রদান করার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, জুলাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের নানা ইস্যুতে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিওর ক্লিপের সমন্বয়ে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ভিডিওটির শুরুতে ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম চ্যানেল২৪ এর একটি প্রতিবেদনের শুরুর অংশের সংবাদ পাঠিকার ক্লিপ দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে তাকে,‘বিক্ষোভ আর হাতাহাতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলো নতুন সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ শীর্ষক কথাগুলো বলতে শোনা যায়। এরপরই অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্য প্রদানের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে তাকে, ‘সমন্বয়কদের জানিয়ে দেন, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তাদের জানিয়ে দেন। তারা যেন আজকের দিনের পরে এইভাবে…’ শীর্ষক বক্তব্য দিতে শোনা যায়। তবে উক্ত বক্তব্যের ‘সমন্বয়কদের’ শব্দটি বাকি বক্তব্যের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ শোনায়। পরবর্তীতে ইলিয়াস কাঞ্চনের আরেকটি ভিডিও দেখিয়ে দাবি করা হয়, তিনি ওই জনসভায় ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে সমন্বয়কদের নিষিদ্ধ না করলে খুব শীঘ্রই ড. ইউনূসকেই গদি থেকে টেনে হিচড়ে নামানো হবে।’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন। তবে ভিডিওটি চলাকালীন তার ভয়েস মিউট করা ছিল। পরবর্তীতে তিনি, ‘শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো হচ্ছে। সমন্বয়করা ২৪ এর আন্দোলনের নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। যার লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া।’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে আরেকটি ভিডিও দেখানো হয়। যেখানে তাকে, ‘এর সুষ্ঠু বিচার এরা কখনও করতে পারবে না। কারণ এদের হাত দিয়ে তো এখানে হত্যা হয়েছে। সেখানে তাদের মাধ্যমে কিন্তু সুষ্ঠু বিচার হবে না।’ শীর্ষক কথাগুলো বলতে শোনা যায়। তবে উক্ত ভিডিওটির কোথাও তার মুখ থেকে আলোচিত দাবিটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কথা বলতে শোনা যায়নি।
ভিডিও যাচাই ১
শুরুতে চ্যানেল২৪ এর প্রতিবেদনটি অনুসন্ধানে সংবাদ পাঠিকার বক্তব্যের সূত্র ধরে গণমাধ্যমটির ইউটিউব চ্যানেলে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ আর হাতাহাতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলো নতুন সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ | Channel 24 শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে গঠিত নতুন ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’-এর আত্মপ্রকাশকে কেন্দ্র করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা নিয়ে উক্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। যার সাথে আলোচিত দাবিটির কোনো সম্পর্ক নেই।
ভিডিও যাচাই ২
পরবর্তীতে ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্য প্রদানের ভিডিওটি অনুসন্ধানে গণমাধ্যম ভোরের কাগজের ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রচারিত একই ঘটনার ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটি থেকে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনরতদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মাঠে নামেন নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ভিডিওটিতে তাকে উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ কারার জন্যে বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করতে শোনা যায়। তবে কোথাও তাকে সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি তুলতে শোনা যায় না। এছাড়াও দেখা যায়, উক্ত ভিডিওটি ক্রপ করার মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওটিতে ব্যবহৃত ফুটেজটি তৈরি করা হয়েছে।
ভিডিও যাচাই ৩
জনসভায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে সমন্বয়কদের নিষিদ্ধ করার দাবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের দেখানো ভিডিও ফুটেজটির বিষয়ে অনুসন্ধানে মূল ধারার গণমাধ্যম এসএ টিভির ইউটিউব চ্যানেলে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর কেন ক্ষেপলেন ইলিয়াস কাঞ্চন? | SATV শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আলোচিত ভিডিওতে উক্ত জনসভায় ইলিয়াস কাঞ্চনের সমন্বয়কদের নিষিদ্ধ করার দাবি তোলার বিষয়ে বলা হলেও দেখা যায় উক্ত ভিডিওটি মূলত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে তার আলোচনা করার ভিডিও। উক্ত জনসভায় তাকে নিরাপদ সড়ক নিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে দেখা গেলেও আলোচিত দাবিটির বিষয়ে তাকে কোনো কথাই বলতে শোনা যায়না।
ভিডিও যাচাই ৪
সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের বক্তব্য প্রদানের দাবি করে আলোচিত ভিডিওতে দেখানো ফুটেজটির বিষয়ে অনুসন্ধানে দৈনিক সমকাল-এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট প্রচারিত মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।

ভিডিওটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট হওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগেরদিন দেশব্যাপী আন্দোলনকারী, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের উপর হওয়া নির্যাতন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ-বিএসপিপি একটি মানববন্ধন করে। অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন উক্ত কর্মসূচির সময় দেশব্যাপী হওয়া নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। ভিডিওটিতে সেটিই দেখানো হয়েছে। তবে সেখানে আলোচিত দাবির প্রেক্ষিতে তাকে কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। এছাড়াও উক্ত ভিডিওটি সমন্বয়কদের দল গঠনেরও বেশ আগের। অর্থাৎ, এর সাথে আলোচিত দাবির কোনো সম্পর্ক নেই।
পরবর্তীতে ইলিয়াস কাঞ্চন সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে কোনো বক্তব্য প্রদান করেছেন কিনা জানতে বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও গণমাধ্যম কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে ইলিয়াস কাঞ্চন ও সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দলকে জড়িয়ে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
সুতরাং, সমন্বয়কদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হুঁশিয়ারি প্রদানের নামে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।