বিদায়ী ২০২৪ সাল বাংলাদেশের জন্য নানা দিক থেকে ঘটনাবহুল একটি বছর ছিল। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বয়কটের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তবে, মাত্র সাত মাসের মাথায় গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ০৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি ২০২৪ সালজুড়ে ছিল ভারত ও কোকা-কোলা বয়কট আন্দোলন, রাসেল’স ভাইপারের আতঙ্ক, বহুল আলোচিত ‘ছাগল কাণ্ড’ এবং পিএসসির প্রশ্নফাঁসের মতো নানা ইস্যু। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ২০২৪ সাল ছিল ভয়াবহ। ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। অন্যদিকে, আগস্টের বন্যায় দেশের উত্তরাঞ্চল বিপর্যস্ত হয়। ২০২৪ সাল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল বেশ ঘটনাবহুল। বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে, বাবরি মসজিদের স্থানে নির্মিত রাম মন্দিরের উদ্বোধন, ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত, এবং সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার এবং সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবহারকারীদের ছড়ানো গুজব দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দেয়। ঘটনাবহুল ২০২৪ সালে গুজব ছড়ানোর হার আগের যেকোনো বছরের তুলনায় ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। রিউমর স্ক্যানার-এর এই বিশেষ প্রতিবেদনে মাসভিত্তিক আলোচিত গুজবগুলো তুলে ধরা হবে, স্মৃতিচারণার সঙ্গে জানানো হবে সেই গুজবগুলোর পেছনের সত্য।
জানুয়ারি
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুজব ছড়ানোর প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। রিউমর স্ক্যানার টিম নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ৯১টি গুজব শনাক্ত করেছে। মাসের শেষদিকে, ২২ জানুয়ারি ভারতের অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনও বাংলাদেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। এ ঘটনাকে ঘিরেও গুজব ছড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে, যার মধ্যে ১২টি গুজব শনাক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম নিয়েও বিতর্ক তখনো চলমান ছিল। জানুয়ারি মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য ফেসবুকে
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে সংঘর্ষে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন দাবি ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে সর্বনিম্ন ২৫ জন থেকে সর্বোচ্চ ৭০ জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের একটি লাইভ ভিডিওতেও এই ধরনের দাবি উঠে আসে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারির মধ্যে সহিংস ঘটনায় মোট ৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে নির্বাচনের দিন নিহত হয়েছেন ২ জন।
২. এনসিটিবির পাঠ্য বইয়ের নয়, ‘ঝর্ণার গল্প’ শিরোনামের পাঠের ছবিটি পুরোনো একটি পাইলট প্রকল্পের বইয়ের
সামাজিক মাধ্যমে ‘সে খেয়াল করলো তার বুকের দু’পাশটা ফুলে যাচ্ছে এবং বগলে ও যৌনাঙ্গে চুল গজাচ্ছে’ শীর্ষক লেখা যুক্ত একটি বইয়ের পৃষ্ঠা শেয়ার করে দাবি করা হয়, এটি নতুন শিক্ষাক্রমের বই এবং এতে আপত্তিকর বিষয়বস্তু রয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি কোনো পাঠ্যবই নয় বরং ২০২২ সালে জেনারেশন ব্রেকথ্রো প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট কিছু স্কুলে ব্যবহৃত একটি পাইলট বই। এই বইটি বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে না এবং এটি নতুন শিক্ষাক্রমের অংশও নয়।
ফেব্রুয়ারি
ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত। সাধারণত এ সময় ভাষা ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক গুজব ছড়ায়। তবে এবার ভাষার পাশাপাশি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংকট ও রাজধানীর বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ড ছিল আলোচনায়। এই দুই ঘটনায় রিউমর স্ক্যানার টিম ৩টি করে গুজব শনাক্ত করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. বাংলা সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নয়
প্রায় দুই দশক ধরে দাবি করা হচ্ছে, বাংলা সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা। এটি বাংলাদেশি গণমাধ্যম, পাঠ্যবই, এমনকি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও উঠে এসেছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিয়েরা লিওনের একমাত্র সরকারি ভাষা ইংরেজি। দেশটিতে ক্রিও, মেন্দে, তেমনে এবং লিম্বাসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় ভাষা প্রচলিত থাকলেও, বাংলা সেখানে কোনো দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। দেশি-বিদেশি গবেষণা ও প্রামাণ্য সূত্র বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই।
২. ‘বাংলাদেশ পুলিশে ৮০ হাজার ভারতীয় চাকরি করে’ দাবিতে যমুনা টিভি কোনো সংবাদ প্রচার করেনি
সামাজিক মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত একটি দাবিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশের চাকরিতে ৮০ হাজার ভারতীয় হিন্দু কর্মরত। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই গুজব নতুন করে ভাইরাল হয়, দাবিটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় যমুনা টিভির অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান ইনভেস্টিগেশন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির নাম। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, যমুনা টিভি এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন কখনো প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিদেশি নাগরিকদের অংশগ্রহণের কোনো আইনগত সুযোগ নেই। ফলে, এই দাবিটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
মার্চ
মার্চ মাসে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর অপহরণের ঘটনা ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই ঘটনাকে ঘিরে মোট ১০টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। মার্চ মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্ত্রী মিলিকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি লিখেননি
১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার স্ত্রী মিলি রহমানকে চিঠি লিখেছিলেন দাবিতে “একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো…” শিরোনামের একটি চিঠি দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চিঠিটি মতিউর রহমানের লেখা নয়। এটি ২০১৩ সালে আরিফ মঈনুদ্দীন নামে একজন ব্যক্তি লিখেছিলেন।
২. সেনাবাহিনীর বরাতে প্রচারিত রক্তে গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিস পরীক্ষা সংক্রান্ত রেড অ্যালার্টটি ভুয়া
ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরাতে একটি রেড এলার্ট শীর্ষক পোস্ট ভাইরাল হয়। এতে দাবি করা হয়, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পরিচয়ে কেউ বাসায় এসে রক্তের গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ তারা জঙ্গি এবং রক্তে এইচআইভি ভাইরাস প্রবেশ করায়। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ধরনের কোনো সতর্কবার্তা কখনো দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৮ সাল থেকেই এই ভুয়া বার্তাটি বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে।
৩. ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধার করেনি
১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, এটি ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধার করেছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি মিথ্যা। ভারতের নৌবাহিনীর এক্স অ্যাকাউন্টে চার জলদস্যুর ছবি প্রকাশের পর এই দাবিটি ছড়িয়ে পড়ে।
এপ্রিল
এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশে তীব্র দাবদাহ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। একই সঙ্গে পবিত্র রমজান শেষে ১০ এপ্রিল উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর। এদিকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে ১৮টি এবং দাবদাহ নিয়ে ৪টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এপ্রিল মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. ২৫ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত নওতাপ চলার কোনো তথ্য দেয়নি নাসা
তীব্র দাবদাহের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাসার বরাতে দাবি করা হয়, আগামী ২৫ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত নওতাপ চলবে, যখন তাপমাত্রা চরম আকার ধারণ করবে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, নাসা এ ধরনের কোনো তথ্য বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। বরং ভারতের একটি গণমাধ্যমে জ্যোতিষীদের বরাতে প্রচারিত তথ্যকে নাসার নামে প্রচার করা হয়েছে।
২. কাবা শরীফের কোনো ইমাম রমজানের শেষ দশ দিনের বিশেষ আমল নিয়ে এই পরামর্শগুলো দেননি
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত একটি দাবিতে বলা হয়, কাবা শরীফের ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইস বা শায়খ মাহের আল-মুয়ায়ক্বিলি রমজানের শেষ দশ দিনে তিনটি বিশেষ আমল করার কথা বলেছেন। এসব আমলের মধ্যে রয়েছে প্রতিদিন এক টাকা দান, দুই রাকা’আত নফল সালাত এবং তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করার কথা। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দাবি সঠিক নয়। কাবার কোনো ইমামই এ ধরনের পরামর্শ দেননি। হারামাইন শরীফের অফিশিয়াল সূত্রের বরাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
মে
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বাংলাদেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির আকস্মিক মৃত্যু ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ঘূর্ণিঝড় রিমালকে ঘিরে ১০টি এবং ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ৯টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। মে মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. বঙ্গবন্ধু টানেল ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকে পড়েছে দাবিতে ছড়ালো চীনের ভিডিও
২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়, যা পরদিন ২৭ মে সকালে পুনরায় চালু হয়। এই পরিস্থিতিতে, একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করা হয় টানেলটি ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকে যাওয়ায় এটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটি চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেলের নয়, বরং চীনের চংকিং তুঝু টানেলের।
২. সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারমূলক ভুয়া বিজ্ঞপ্তির ওপর কালবেলায় প্রথম পাতায় সংবাদ প্রকাশ
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিসের নামে একটি কথিত বিজ্ঞপ্তি ভাইরাল হয়। দাবি করা হয়, হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে দলটি। এই বিজ্ঞপ্তি ব্যবহার করে ভারতের সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে নানা অপপ্রচার চালানো হয়। ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ওই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে তৈরি কালবেলার একটি অনলাইন প্রতিবেদন তাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিজ্ঞপ্তিটি ২০২২ সালের একটি বিজ্ঞপ্তি সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে। ৩ এপ্রিল রিউমর স্ক্যানার ফেসবুকে বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে ফ্যাক্ট-চেক প্রকাশ করলেও, ৪ মে কালবেলার প্রিন্ট সংস্করণে আবারও ওই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জুন
জুন মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাসেল’স ভাইপার সাপের উপস্থিতি নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সাপটি সম্পর্কে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ভুল তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে। রাসেল’স ভাইপার ইস্যু নিয়ে মোট ২০টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। জুন মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. এসএসসির নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে ভুল তথ্য প্রচার
২০২৩ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর, ২০২৪ সালে এটি তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষার জন্য নতুন গ্রেডিং সিস্টেম দাবিতে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে নতুন গ্রেড, গ্রেড পয়েন্ট এবং শ্রেণিবিন্যাসের তথ্য তুলে ধরা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবির তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নতুন শিক্ষাক্রমে নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন নয়, বরং ধাপভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রস্তাবনা করা হয়েছিল।
২. ফিলিস্তিনের রাফাতে আজান না হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ইয়াসির আদ দৌসারি
২৬ মে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার রাফা শরণার্থী ক্যাম্পে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৪৫ জন নিহত হওয়ার পর শায়খ ইয়াসির আদ দৌসারির একটি মন্তব্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায়। দাবিতে বলা হয়, তিনি বলেছেন, “আজ রাফায় আজান হলো না কেন? হয়তো আর কোনো মসজিদ বাকি নেই অথবা মুয়াজ্জিনগণ বেঁচে নেই।” রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শায়খ দৌসারি এ ধরনের কোনো মন্তব্য করেননি। বরং তার নামে চালু থাকা একটি ফেসবুক ফ্যানপেজের পোস্ট থেকে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এছাড়া, রাফায় মসজিদে আজান বন্ধ হয়নি বলেও স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জুলাই
৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন মাসজুড়ে চরম আকার ধারণ করে, যা নিয়ন্ত্রণে সরকার ইন্টারনেট সেবা সীমিতসহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পুরো মাসজুড়ে সংঘর্ষ, হতাহতের ঘটনা এবং আন্দোলনকে ঘিরে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া, জুলাই মাসের শুরুতেই পিএসসির প্রশ্নফাঁস ইস্যু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ১৮৯টি এবং পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত ৯টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। জুলাই মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. আন্দোলনে নিহতের বিভিন্ন গুজব-
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম শহীদের খবর আসে ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তবে তার আগেই আন্দোলনে নিহতদের সংখ্যা, পুরোনো ছবি ব্যবহার করে নিহত দাবি, এবং আহত ব্যক্তিকে মৃত বলে প্রচারসহ নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে অসংখ্য ব্যক্তি নিহত ও আহত হলেও, এসব গুজব জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। এমন উল্লেখযোগ্য কিছু গুজব হলো-
ক. কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিতা নিহত হননি
খ. কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাবিতে নিহতের গুজবে সয়লাব ফেসবুক
২. কোটা সংস্কার আন্দোলনে ২৭ জন নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের দাবিটি গুজব
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ফেসবুকে দাবি করা হয় ঢাবির রোকেয়া হল ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ জন নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি মিথ্যা। কোনোরকম তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছিল।
৩. ঢাবি শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে নয়, শাবিপ্রবির ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কক্ষ থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়েছে
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে অস্ত্র ও মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে দাবিতে একটি ছবি সামাজি যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিতে থাকা অস্ত্র ও মদের বোতলগুলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শাহপরান হলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
৪. কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় আহত হওয়া ঢাবির এই ভাইরাল নারী শিক্ষার্থী মারা যাননি
কোটা সংস্কার আন্দোলনে মারধরের শিকার একজন নারীর ছবির মাধ্যমে ফেসবুকে দাবি করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার মীম নিহত হয়েছেন। অন্য কিছু পোস্টে দাবি করা হয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইসলাম তার বোনকে নিয়ে পোস্ট করেছেন। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছবির নারী আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা আহমেদ তন্নি। তিনি সহিংসতায় আহত হয়েছেন তবে তার নিহতের দাবি মিথ্যা। পাশাপাশি, রাকিব নামে তার কোনো ভাই থাকার দাবিটিও মিথ্যা।
৫. কোটা আন্দোলনে নিহত হওয়া ফাইয়াজকে নিয়ে কালবেলাকে উদ্ধৃত করে ভুয়া তথ্য প্রচার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত ফারহান ফাইয়াজকে নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কালবেলার বরাতে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, তার টিউশন শিক্ষক ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক আবির হোসাইন এবং তিনি ফারহানকে কৌশলে হত্যা করেছেন। এই দাবিটি বিভিন্ন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও প্রচার করেন। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কালবেলা এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি এবং অন্য কোনো বিশ্বস্ত গণমাধ্যমেও এর সত্যতা মেলেনি।
৬. সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, ভিডিওটিতে প্রদর্শিত ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া ব্যক্তিরা ছাত্রলীগ কর্মী
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিওর মাধ্যমে দাবি করা হয় কুমিল্লায় ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এটি ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ফেলে দেওয়ার দৃশ্য নয়। ঘটনাটি কুমিল্লারও নয়, বরং চট্টগ্রামে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী পরিচয়ধারীদের দ্বারা ছাত্রলীগ কর্মীদের ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য।
৭. বিএনপি নেতা আমীর খসরুর কথিত ফোনালাপের অডিওটি কোটা আন্দোলনের নয়
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ফোনালাপের মাধ্যমে দাবি করা হয়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ‘নওমি’ নামে এক শিক্ষার্থীকে চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। ২৬ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদও গণমাধ্যমে এ ফোনালাপের ভিত্তিতে আমীর খসরুর সম্পৃক্ততা নিয়ে মন্তব্য করেন। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রচারিত অডিওটি ২০২৪ সালের নয়; এটি ২০১৮ সাল থেকেই অনলাইনে বিদ্যমান।
আগস্ট
গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সরকার পতন ও পুলিশের কর্মবিরতির ফলে দেশে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়। একই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। আগস্ট মাসে ছড়ানো গুজবগুলোর মধ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ৬৭টি, ১৫ আগস্ট কেন্দ্র করে ৬টি, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ৮৮টি, সচিবালয়ে আনসার বাহিনী সংক্রান্ত ৪টি এবং গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী-জনতা সংঘর্ষ নিয়ে ২টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। আগস্ট মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. জবি শিক্ষার্থীর প্রতীকী প্রতিবাদের ভিডিওকে ছাত্রলীগ নেত্রীর করুণ অবস্থার ভিডিও দাবিতে প্রচার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখে স্কচটেপ ও হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এক নারীর ভিডিওর মাধ্যমে দাবি করা হয়, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রী। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভিডিওটির নারী শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেত্রী নন। এটি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মৌন প্রতিবাদের অভিনয়ের দৃশ্য।
২. আন্দোলন প্রত্যাহারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি প্রচার
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুটি বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়। প্রথমটিতে দাবি করা হয়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহতদের মৃত্যুর তদন্ত ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারকে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। দ্বিতীয়টিতে সাধারণ ছাত্রদের ৯ দফা দাবির বাস্তবায়নে সরকারকে ৩ মাস সময় দিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার দাবি করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি, উভয় বিজ্ঞপ্তিই ভুয়া।
৩. কোটা আন্দোলন ইস্যুতে পাকিস্তান হাইকমিশনের নামে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি
কোটা আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তান হাইকমিশনের একটি কথিত বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দাবি করা হয়, আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক পাকিস্তানের সাহায্য চেয়েছেন এবং হাইকমিশন সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বিজ্ঞপ্তি ভুয়া এবং এটি হাইকমিশনের প্রকাশিত অন্য একটি বিজ্ঞপ্তি এডিট করে তৈরি করা হয়েছে।
৪. আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রত্যাহারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ড এবং দেশের সব মহানগর ও জেলায় জমায়েত কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট এই কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে বলে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ কর্মসূচি বাতিল করেনি। এ দাবিতে প্রচারিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া। বিষয়টি দলটির ওয়েব টিমের কো-অর্ডিনেটর তন্ময় আহমেদ নিশ্চিত করেছেন।
৫. সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার দাবিটি গুজব
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংসদ ভবনে গণকবরের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সামিরা ইসলাম আফরোজ নামের ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি লাইভ ভিডিওতে দাবি করেন, সংসদ ভবনে গণকবর দেওয়া হয়েছে এবং লাশের গন্ধে ভেতরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। তবে তার পোস্টে কোনো লাশ বা গণকবরের দৃশ্য দেখা যায়নি। পরে তিনি স্বীকার করেন, নিজ চোখে কিছু দেখেননি, বরং অন্যদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে এমন দাবি করেছিলেন। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, সংসদ ভবনে গণকবরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘটনাস্থল থেকে কিছু বই-খাতা ও গন্ধ পাওয়া গেলেও বইগুলো সংসদ ভবনের এক কর্মচারীর ছেলের এবং গন্ধটি সম্ভবত কোনো মৃত প্রাণীর বলে ধারণা করা হয়। এ গুজব ছড়ানোর সময় কিছু পুরাতন মরদেহের ছবি ও ভিডিও প্রচার করা হয়, যা পরবর্তীতে যাত্রাবাড়ী ও ঝিনাইদহের পুরোনো ঘটনার বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে।
৬. ফ্যাক্টচেক: ইসরায়েলকে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দেননি ড. মুহাম্মদ ইউনূস
৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দাবি করা হয়, ড. ইউনূস ইসরায়েলকে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ভিত্তিহীন দাবিটি ২০২৩ সালে হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের সময় ছড়ানো হয়েছিল। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে নিশ্চিত করেছে। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর গুজবটি পুনরায় ভাইরাল হয়।
৭. এনায়েতপুর থানায় হামলায় গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য নিহতের গুজব
০৩ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এর জেরে ০৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় সংঘর্ষে ১৫ পুলিশ সদস্য নিহত হন, যা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এরপর সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, নিহতদের মধ্যে একজন গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য ছিলেন এবং তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি সত্য নয়। নিহতদের মধ্যে কোনো নারী পুলিশ সদস্য ছিলেন না। প্রচারিত ছবিটি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন নারী সদস্যের, যার এই ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। পরবর্তীতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ফেসবুক পেজ, ১৫ আগস্ট নিয়ে শেখ হাসিনার লিখিত বক্তব্যে, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকেও একই দাবি প্রচারিত হয়।
৮. কোটা সংস্কার আন্দোলনে পাবনার রাফি নিহত হননি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে পাবনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে রাফিউল ইসলাম রাফি নামে এক শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মারা যাওয়ার সময় তিনি তার বাবা নেই ও ছোট বোনকে দেখে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বলে একটি দাবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাফি মারা যাননি, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং বর্তমানে সুস্থ আছেন। রাফির মা নেই, তবে বাবা জীবিত আছেন এবং ছোট বোনকে দেখে রাখার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
৯. বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক্সে সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের ভয়াবহতা
শেখ হাসিনার পতনের পরবর্তী তিনদিনেও দেশে সহিংসতা অব্যাহত থাকে, যার মধ্যে রাজনৈতিক হামলা, হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম এক্স (সাবেক টুইটার) সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক্সে অন্তত ৫০টি অ্যাকাউন্ট সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ছবি, ভিডিও এবং তথ্য বিকৃত করে সাম্প্রদায়িকভাবে উপস্থাপন করেছে। ৫ থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত এসব পোস্ট ১ কোটি ৫৪ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে। বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতীয়, এবং কিছু ভুয়া তথ্য ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে।
সেপ্টেম্বর
সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। একই সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ওঠে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অংশগ্রহণ এবং দেশের উত্তরবঙ্গে বন্যার ঘটনাও ছিল আলোচনায়। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে ২টি, বন্যা সংক্রান্ত ৭টি, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন নিয়ে ১৬টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট নিয়ে ১৭টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। সেপ্টেম্বর মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. পাহাড়ে সংকট: থেমে নেই অপতথ্যের প্রবাহও
সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবকের গণপিটুনিতে মৃত্যুর পর পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যা রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে যায়। এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অন্তত ১১টি গুজব শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার টিম, যার মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনীর অস্ত্রসহ পুরনো ছবি পাহাড়ের ঘটনার বলে দাবি, শরণার্থীদের পুরনো ছবি ব্যবহার করে বাস্তুচ্যুতির দাবি, পোড়ানো মূর্তির পুরনো ছবি, ফিলিপাইন ও আসামের অস্ত্রধারীদের ভিডিওকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা হিসেবে প্রচার, মার্কিন সেনা প্রবেশের মিথ্যা দাবি এবং মিয়ানমারের সংঘর্ষের ছবি রাঙামাটির ঘটনা বলে উপস্থাপন করা। এছাড়া জুনান চাকমা নামে একজন নিহত হওয়ার ভুয়া দাবি করা হয়।
২. শেখ মুজিবুর রহমানের আসল নাম দেবদাস চক্রবর্তী নয়
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম পরিচয় নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয় তার আসল নাম ছিল দেবদাস চক্রবর্তী এবং মায়ের নাম গৌরিবালা দাস। দাবিগুলোতে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৯২৩ সালে কলকাতা সিভিল কোর্টের একটি এফিডেভিটের মাধ্যমে শেখ মুজিবের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট প্রমাণিত হয়েছে। ১৯২৩ সালে কলকাতা সিটি সিভিল কোর্ট প্রতিষ্ঠিতই হয়নি; এটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত তথ্যানুযায়ী, শেখ মুজিবুর রহমান তার পিতামাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য উৎস অনুযায়ী, তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন এবং তার নানার নাম ছিল আব্দুল মজিদ।
অক্টোবর
অক্টোবর মাসে সারাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। এ সময় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণায় বন্যার ঘটনাও আলোচনায় আসে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ১৫টি এবং বন্যা নিয়ে ৩টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। অক্টোবর মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. প্রধান উপদেষ্টা ও সেনা প্রধানের দ্বন্দ্বের দাবি ঘিরে অপতথ্য প্রবাহের এক রাত
৮ অক্টোবর দুপুরের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক অবস্থান নিয়েছে এবং সেখানে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে। দাবি করা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর জন্য তাকে চাপের মুখে রাখা হয়েছে। এমনকি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পদত্যাগ করতে তাকে বাধ্য করা হতে পারে বলেও প্রচার করা হয়। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। যমুনায় সেনা সদস্যদের উপস্থিতি আসলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিয়মিত নিরাপত্তা কার্যক্রমের অংশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সেনা সদস্যদের উপস্থিতি ও টহল অব্যাহত রয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক নিরাপত্তার অংশ। গুজবটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও, ভিন্ন ঘটনার ছবি ও সেনাবাহিনীর নামে ভুয়া প্রেস রিলিজ ছড়ানো হয়। এমনকি পুরনো লাইভ ভিডিও ব্যবহার করে সেনাপ্রধান ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে উত্তেজনা চলছে বলে দাবি করা হয়। সেনাবাহিনীর নামে প্রচারিত কথিত প্রেস রিলিজটি ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে আইএসপিআর। সংস্থাটি জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ সাধারণত স্বাক্ষরিত ও অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়, যা এই ক্ষেত্রে ঘটেনি। রিউমর স্ক্যানারের আরও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, যমুনার সামনে সেনা ট্যাংক অবস্থানের ভিডিওর দাবিও বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে, এটি নিরাপত্তা বাহিনীর রুটিন পরিবর্তনের অংশ ছিল। পাশাপাশি দুর্গাপূজা ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট, প্রধান উপদেষ্টাকে ঘিরে সেনাবাহিনীর চাপ সৃষ্টি, রুদ্ধদ্বার বৈঠক কিংবা পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার দাবিগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার।
২. দুর্গাপূজায়ও থেমে ছিল না অপতথ্যের প্রবাহ
সনাতন ধর্মাবলাম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে প্রতিবছরই কমবেশি সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার থেকে শুরু করে অপতথ্য, ভুল তথ্য এবং সর্বোপরি গুজব প্রচারের হার বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়৷ এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ চলতি বছর দুর্গাপূজা সম্পর্কিত ১৫টি অপতথ্য শনাক্ত করে ১৪টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে এসব অপতথ্য শনাক্ত করা হয়।
নভেম্বর
নভেম্বর মাসের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই মাসে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম কর্মসূচির ডাক দেয় ১০ নভেম্বর। এছাড়া সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাস গ্রেফতার এবং গ্রেফতারের পর সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ড, ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষসহ নানা ঘটনায় মাসটি ছিল আলোচিত। নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ৭টি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট নিয়ে ১৭টি, আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে ২১টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। নভেম্বর মাসে ছড়ানো আলোচিত গুজবগুলো হলো –
১. ২০১৯ সালে গ্রেফতার হিযবুত তাহ্রীরের মাহফুজ আর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ একই ব্যক্তি নন
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ০৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। মাহফুজ আলমকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয় যে, ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহ্রীর নেতা মাহফুজ ও মাহফুজ আলম একই ব্যক্তি। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইজন ব্যক্তি।
২. নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে ইন্টারনেটে যত অপতথ্য
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম কর্মসূচির ডাক দেয় ১০ নভেম্বর। এদিন শহীদ নূর হোসেন দিবসে ঢাকায় দিনভর ছিল উত্তেজনা। রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে দলটির বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আগের রাত (০৯ নভেম্বর) থেকেই একাধিক অপতথ্যের প্রচার শুরু হতে দেখে রিউমর স্ক্যানার। ১০ নভেম্বর দিনভরও তথ্য, ছবি এবং ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপতথ্যের ছড়াছড়ি দেখা যায়। রিউমর স্ক্যানার এ সংক্রান্ত ১৬টি দাবি যাচাই করে ১৫টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে। এসব দাবির ক্ষেত্রে পুরোনো ছবি-ভিডিও যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেনাবাহিনীকে জড়িয়েও ভুয়া তথ্যের প্রচার।
৩. মুগ্ধ এবং স্নিগ্ধ দু’জন একই ব্যক্তি নন, জমজ ভাই
১৮ জুলাই উত্তরা আজমপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়া বিইউপি শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন। সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, মুগ্ধ ও তার জমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি এবং মুগ্ধ নামে কেউ ছিলেন না। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি এবং তারা দুইজন জমজ ভাই। তাদের একসঙ্গে তোলা অসংখ্য ছবি ও ভিডিওসহ বিভিন্ন প্রমাণ বিশ্লেষণ করে এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
৪. চিন্ময়ের গ্রেপ্তার এবং সাইফুল হত্যাকাণ্ড ঘিরে ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে যত অপতথ্য
২৫ নভেম্বর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে তার অনুসারীদের বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষ বাধে, যার একপর্যায়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে শনাক্ত করা গুজবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—ভুয়া ফটোকার্ড, ডিবি পুলিশের কাছে চিন্ময়ের ভুয়া স্বীকারোক্তি, পুরোনো ভিডিও ও ছবি ব্যবহার, নিহত আইনজীবীর পরিচয় বিকৃত করে প্রচার এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর ভুয়া দাবি। এমনকি ভারতের কিছু গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এই ইস্যুতে গুজব ছড়াতে দেখা গেছে।
ডিসেম্বর
ডিসেম্বর মাসের আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে ছিল বিজয় দিবস ও ইজতেমা। ইজতেমা ইস্যুতে ৩টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এ মাসে ছড়িয়ে পড়া উল্লেখযোগ্য গুজবগুলোর মধ্যে ছিল –
১. লালমনিরহাটে চীনের সহায়তায় বিমান ঘাঁটি তৈরির বিষয়টি ভুয়া
সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হয়, চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চিকেন নেকের কাছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ দাবির কোনো ভিত্তি নেই। লালমনিরহাটের বিমানবন্দর দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বন্ধ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এ বিমানবন্দর চালুর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।২. শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির খবরটি গুজব
২২ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি হয়েছে দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এ দাবি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এবং বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরও নিশ্চিত করেছে যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারির তথ্য সঠিক নয়।
৩. চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে ইসকন কোনো বিবৃতি দেয়নি
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ইসকন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের কৃষ্ণ কনশাসনেস সোসাইটি (KCS) নামের একটি ভিন্ন সংগঠনের এক্স পোস্টের ভিত্তিতে এই গুজব ছড়ানো হয়েছে।